বিসিবির কাছ থেকে বিদায়ী সম্মাননা পাওয়ার আয়োজনে তামিম ইকবাল বললেন, ব্যক্তি ক্রিকেটারের উগ্র সমর্থন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ধ্বংস করে দিতে পারে, সমর্থন করতে হবে শুধু দেশকে।
Published : 08 Feb 2025, 08:50 AM
তামিম ইকবালের জন্য উপলক্ষটা ছিল উদযাপনের। মাত্রই তখন বিপিএলের শিরোপা জিতেছেন টানা দ্বিতীয়বারের মতো। তবে উৎসবের আবহের মধ্যে বেজে উঠেছে বিদায়ের রাগিনীও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেওয়া ক্রিকেটারকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দিল বিসিবি। সেই আয়োজনেই তামিমের বিদায়ী বার্তা, ব্যক্তি ক্রিকেটারের উগ্র সমর্থন বন্ধ করে গলা ফাটাতে হবে শুধুই দেশের হয়ে।
এবারের বিপিএলের সিলেট পর্ব চলার সময় গত ১০ জানুয়ারি সামাজিক মাধ্যমে তামিম জানিয়ে দেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর দেখা যাবে না তাকে। দেশের সাবেক অধিনায়ক ও সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন মাঠ থেকে বিদায় জানাতে না পারলেও তার জন্য বিশেষ আয়োজন করে বিসিবি। বিপিএল ফাইনাল শেষে শুক্রবার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আগে ছিল তামিমের জন্য এই পর্ব।
বাংলাদেশের হয়ে তামিমের তিন সংস্করণের জার্সি একটি ফ্রেমে সুদৃশ্য ফ্রেমে বাঁধাই করে তার হাতে তুলে দেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ। পরে তাকে দেওয়া হয় একটি ক্রেস্টও।
পরে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তামিম ফিরে তাকান তার প্রায় দেড় যুগের ক্যারিয়ারে। ফিরে যান একদম শুরুর দিনগুলিতেও।
“দারুণ এক ভ্রমণ ছিল আমার জন্য। ১৭ বছর প্রতিনিধিত্ব করেছি আমার দেশকে। শুরু হয়েছিল অনেক ছোট্টবেলায়। আমার চাচা ছিলেন জাতীয় দলের অধিনায়ক (আকরাম খান), বাংলাদেশ যখন ট্রফি জয় করে (১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি), তখন দেখেছি গোটা দেশের আনন্দ ছিল ভিন্ন মাত্রার। সেদিনই ঠিক করেছিলাম, ক্রিকেটার হতে চাই।”
“সবসময়ই বলেছি, আমার বাবার স্বপ্ন ছিল আমি জাতীয় দলে খেলব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি আমার সঙ্গে নেই। তবে আমি নিশ্চিত, দেশের জন্য যা করেছি, তিনি গর্বিতই হবেন।”
জাতীয় দলে তামিমের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটাতেই কখনও নির্বাচক, কখনও প্রধান নির্বাচক ও পরে পরিচালক হিসেবে বিসিবিতে ছিলেন তার চাচা আকরাম খান। আছেন এখনও। ‘চাচার জোর’ নিয়ে তামিমকে ক্যারিয়ারজুড়েই নানা কথা শুনতে হয়েছে বিস্তর। বিদায় বেলায় মৃদু হাসিতে সেই প্রসঙ্গও স্পর্শ করলেন তিনি।
“বাংলাদেশের হয়ে যেখানেই খেলেছি, প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। কিছু মানুষকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে। আমার পরিবার থেকে শুরু করলে, আমার চাচা আকরাম খান, তিনি আমাদেরকে পথ দেখিয়েছেন। ১৭ বছরের সমালোচনা আমাকে ও চাচাকে জড়িয়ে… সবাই জানি, তা কেমন ছিল। অথচ এসব কখনোই সত্যি ছিল না। ক্রিকেট কখনোই এতটা সহজ নয়। আপনি সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষের সন্তানও হতে পারেন, কিন্তু পারফর্ম না করলে এই খেলায় কখনও টিকতে পারবেন না। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই পরিবারের জন্য যা কিছু করেছেন। তিনিই আমাদেরকে দেখিয়েছেন, ক্রিকেট আসলে কেমন।”
“তার পর আমার অন্য চাচারা… এবং অন্য সবার নাম এখানে উল্লেখ করা কঠিন। আমার স্ত্রী, সন্তানরা, আমার কোচরা, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।”
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের ধরনটা নিয়ে আক্ষেপ কিছুটা ফুটে উঠল তার কণ্ঠে। তবে এই বিশেষ আয়োজনের জন্য কৃতজ্ঞতাও জানালেন বিসিবির প্রতি।
“দারুণ এক ভ্রমণ ছিল। কখনোই এভাবে শেষ হওয়ার কথা ছিল না। দুর্ভাগ্যজনক যে, এটাই হচ্ছে। তবে যতদিন খেলেছি, প্রতিটি মুহূর্ত ভালো লেগেছে। আর যতদিন খেলব (ঘরোয়া ক্রিকেটে), উপভোগ করার চেষ্টা করব। কারণ, আমার ঘরে এখন বড় এক ভক্ত আছে, আমার ছেলে।”
“বিসিবিকে ধন্যবাদ জানাতে হবে আমার। ১৭ বছর তাদের তত্ত্বাবধানে খেলেছি। আমাকে ও সব ক্রিকেটারের দেখভাল করেছে তারা। কিছু ‘যদি-কিন্তু’ সবসময়য়ই থাকে। কিন্তু কৃতজ্ঞতার প্রকাশ করতেই হবে। তারা অভিভাবকের মতো আমাদের দেখভাল করেছে। এত মানুষের সামনে ক্যারিয়ার শেষ করার সুযোগ দেওয়াতেও বিসিবিকে ধন্যবাদ জানাই। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। আরও বছর দুয়েক বিপিএল ও ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে আপনারা দেখবেন আমাকে। সবকিছুর জন্য আবারও ধন্যবাদ।”
এক পর্যায়ে তামিমের স্ত্রী ও দুই সন্তান তার পাশে গিয়ে দাঁড়ান মঞ্চে। তাদেরকে পাশে নিয়ে তামিম বলেন, “আমি বাংলায় একটি অনুরোধ করতে চাই…”, এটুকু বলে অবশ্য ইংলিশেই বললেন। সেখানেই আকুতি জানালেন দেশের ক্রিকেট অনুসারীদের প্রতি।
"দেখুন, এখানে কোনো তামিমিয়ান, কোনো সাকিবিয়ান বা মাশরাফিয়ান নেই। শুধু একটাই সমর্থনের বিষয় আছে, বাংলাদেশ। এই ব্যাপারগুলো বাংলাদেশ ক্রিকেটকে ধ্বংস করছে। তাই প্লিজ প্লিজ প্লিজ… এসব বন্ধ করুন। আপনারা আমার, সাকিবের অথবা মাশরাফির সমর্থক হতে পারেন বা অন্য কারও হতে পারেন। কিন্তু আমরা যখন খেলি, বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবেই খেলি। এগুলো বন্ধ করুন, কারণ এসব জিনিস তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করে।”
“আমার পক্ষ থেকে এটিই শেষ বার্তা। আমরা সবাই বাংলাদেশি। আর কিছু নই। তাই দয়া করে দলকে সমর্থন করুন। এই দলটা খুবই তরুণ দল। তারা ভুল করবে। তারা ব্যর্থ হবে। তবে এটি আপনাদেরই দল। তাই সবাই একত্রে থাকুন। এখানে ব্যক্তিগত কিছু নেই। একটিই দল আছে, সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।”