তখনকার জাপানি সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষকরাই হতেন ছাত্রদের ভবিষ্যৎ চাকুরি এবং বিবাহ, সব কিছুরই অভিভাবক।
Published : 31 Jan 2025, 10:00 PM
ইউনেস্কোর ডিপ্লোমা শেষ করে ঢাকার উদ্দেশ্যে ওসাকা ছাড়লাম ১৯৭৯ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর। ব্যাংককে একরাত যাত্রাবিরতির পর ঢাকা পৌঁছাই পরদিন। দীর্ঘদিন জাপান বাসের পর দেশে ফিরেছি। কাজেই দেশে আমার কদর ও ব্যস্ততাও বেশি। শিক্ষক, বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করছি, একইসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরিতে যোগদানের জন্যও ছুটাছুটি করছি। মনবুশো বৃত্তির দরখাস্তটি পাঠাতে হবে খুবই শীঘ্রই, নির্ধারিত সময়ের মাঝে। দরখাস্তটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রাণরসায়ন বিভাগীয় অধ্যাপকের সই ও প্রসংসাপত্র পেতে বেশি দেরি হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন মিটিঙে ব্যস্ত জীববিজ্ঞান অনুষদ বা বায়োলজিক্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিনের দেখা পাই না। যখন তাঁকে ধরতে পারলাম, সাঁঝের আগে বাড়ি ফেরার জন্য সবে তিনি তাঁর গাড়িতে উঠে বসেছেন। তিনি ছিলেন মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম।
দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, বিশ্ববিদ্যালয় পরদিন বন্ধ। আমার রিকসাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই নিজের পরিচয় দিয়ে দরখাস্তের কয়েকটি জায়গায় তাঁর সই-এর প্রয়োজনীয়তার কথা বললাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন দুইদিন পর শনিবার সই করলে হয় না? বললাম, দরখাস্তটি সময়মতো টোকিয়োয় না পৌঁছালে এ বছর বৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। তিনি বললেন, দিন তাহলে এখানে গাড়িতে বসেই সই করে দিচ্ছি, আমাকে সিঁড়ি ভেঙে আর তিনতলায় উঠতে হবে না। পকেট থেকে কলমটি হাতে নিয়েও থেমে গেলেন! মাথাটি তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নাহ, শনিবার আপনাকে আসতেই হবে, কারণ ডিনের দাপ্তরিক সিলটি তো অপিসের কেরানির কাছে থাকে, সে তো চলে গেছে অনেক আগেই!
কথাগুলো বলতে বলতে আমার চেহারার অসহায়, আশাহত অভিব্যক্তিটি দেখে সাথে সাথে তিনি মত বদলালেন। বললেন, লাগবে না সিল! কোথায় সই করতে হবে বলুন, সই করে নিচে আমি হাতে লিখে দিচ্ছি, ডিন অব দি ফ্যাকাল্টি অব বায়োলোজিক্যাল সায়েন্সেস। আসলে কি জানেন, এই সিলের ব্যাপারটি আমাদের দেশে যতোটা গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা হয়, উন্নত বিশ্বে তা একেবারেই নয়। আমাদের দেশে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, তাই এতো সিল-ছাপ্পরের প্রয়োজন। বিদেশিরা দেখবেন এসবের ধার ধারে না কারণ তাঁরা মানুষকে বিশ্বাস করে। কিন্তু ওরা সময়সীমাকে খুবই মূল্য দেয়। এই বলে নামসহ শুধু সই নয়, নিচে নিজের পরিচয়টুকুও লিখে দিলেন। অভয় দিয়ে আমাকে বললেন, আপনি নিশ্চিত থাকুন যে সিলের অভাবে আপনার দরখাস্তের কোনোই অবমূল্যায়ন ওরা করবে না, প্রয়োজনে ওরা আমার সাথে যোগাযোগ করবে, আজই দরখাস্তটি ডাকযোগে পাঠিয়ে দিন।
অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের অসাধারণ এই সহযোগিতা আমি জীবনভর গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। শুধু অবিশ্বাস নয়, মানুষের অপকার করতেই অভ্যস্ত যে বাঙালি, তাদেরই একজনের পক্ষে অযাচিতভাবে কারো কোনো উপকার করার বিরল এই উদাহরণটি নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম বলে তিনি আমার নামটি জানতেন কিনা জানি না, কিন্তু তাঁর সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় যে ছিল না সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিন্ত। এহেন ব্যক্তি কারো কাছে আমার সম্পর্কে যাচাই না করেই সরল বিশ্বাসে দরখাস্তটিতে সই করে দিয়ে এক মহৎ আসন করে নিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সেই দরখাস্তের ফলেই জাপানের মনবুশো স্কলারশিপটি আমি পেয়েছিলাম সময়মতো। কিন্তু অধ্যাপক ইসলামের সাথে আমার আর দেখা হয়নি। কৃতজ্ঞতাও জানানো হয়নি। তিনি আজ আর বেঁচে নেই।
ডিসেম্বর নাগাদ জাপান সরকার এবং অধ্যাপক কেঞ্জি সোদার যুগপৎ চিঠি থেকে জানতে পারলাম যে বছর বছর নবায়নযোগ্য মনবুশো বৃত্তিটি আমি লাভ করেছি। সোদা-ল্যাবে আমার গবেষণার প্রয়োজনীয় খরচ বাদে আমাকে বিমানে যাতায়ত ভাড়া ও মাসিক ১৪৫,০০০ ইয়েন দেয়া হবে। বৃত্তির পরিমাণটি ইউনেস্কো ফেলোশিপের থেকে যথেষ্ট কম হলেও বিদেশি ছাত্রদের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্তি ছিল।
এবার শুরু হলো বিদেশ গমনে সরকারি ছাড়পত্র জোগাড়ের দুশ্চিন্তা! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অপিস থেকেই সাবধান করে দেয়া হলো মাত্র কয়েকমাস পূর্বেই যেহেতু আমি বিদেশে সময় কাটিয়ে এসেছি,সরকারি সচিবালয় থেকে অনুমতি পাওয়াটা খুব কষ্টকর হয়ে যাবে। কষ্টকর যে হবে তা আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই জানা ছিল। ওসাকায় বন্ধুত্ব হওয়া জনাব সালেহ মতিনের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তাঁর স্ত্রী ছিলেন তখনকার সরকারি জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক। সচিবালয়ের শিক্ষা দপ্তরের সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা ছিলেন তাঁর পূর্বেকার সহকর্মী ও সুহৃদ। মতিন সাহেবের স্ত্রীই নিজে উদ্যোগী হয়ে আমার বিদেশযাত্রার ছাড়পত্রটি জোগাড় করে দিয়েছিলেন।
১৯৮০ সালের জানুয়ারির ২৪ তারিখ ঢাকা থেকে রওনা হয়ে ব্যাংককে একরাত কাটিয়ে পরদিন ওসাকা পৌঁছাই। বিমানবন্দরে অধ্যাপক সোদা-ল্যাবের জোসু ড. কাতসুহিদে তানিযাওয়া আমাকে নিয়ে যেতে এসেছিলেন। নিজে গাড়ি চালাতে চালাতে পথে তিনি ল্যাবের বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের ফিরিস্তি দিলেন যেন পরদিন আমি নিজের গবেষণার বিষয়বস্তু সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি। বিমানবন্দর থেকে প্রায় একঘণ্টা পর তিনি আমাকে কিয়োতোর ইয়ামাশিনা রিউগাকুসেই কাইকান বা ইয়ামাশিনা বিদেশি ছাত্রাবাসে নামিয়ে দিলেন। আগেরবারের জাপান বাস কালে এক বন্ধুর কল্যাণে এই ছাত্রাবাসটির সাথে আমার পরিচয় ছিল।
অধ্যাপক কেঞ্জি সোদা
আমেরিকায় বেড়াতে এসে ৮৬ বছর বয়স্ক জাপানি অধ্যাপক কেঞ্জি সোদা ২০১৯ এপ্রিলের ২৭ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত ওয়াশিংটন ডিসি এলাকায় ছিলেন। সাড়ে তিন দশকের বেশি আগে আমি জাপানে তার ল্যাব ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলাম। তিনি শুধুমাত্র আমার পিএইচডি সুপারভাইজার ছিলেন বললে কমই বলা হবে। আজ পেশা ও কর্মক্ষেত্রে আমার যতো অর্জন তাঁর সিংহ ভাগই তার কল্যাণে সম্ভব হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। এবার তাঁর ওয়াশিংটনে থাকার প্রায় পুরোটা সময় তাই তাঁর সান্নিধ্যেই কাটিয়েছি। তাঁর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে তিনি আমাকে যা যা বলেছিলেন সে সবই বেশি মনে পড়ছে।
পিএইচডি শেষ করার মাস দুই পর ১৯৮৩ সালের অক্টোবরে আমি আমেরিকার মেরিল্যান্ড রাজ্যের বেথেসডা শহরে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ, সংক্ষেপে এনআইএইচ, এ পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করতে আমন্ত্রিত হয়ে আসি। এর ঠিক এক বছর পর তিনি আমাকে দেখতে আসেন। একটি দামি রেস্তোরাঁয় আমাকে আপ্যায়ন করার সময় কথাগুলো বলেছিলেন। তাতে আমার প্রতি তাঁর স্নেহের যেমন সীমা ছিল না, নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে পর্যুদস্ত বাংলাদেশের প্রতিও তাঁর সহানুভূতি প্রকাশ পাচ্ছিল। স্মৃতি থেকে হাতড়ে তাঁর মুখনিঃসৃত কথাগুলোই পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম।
‘আহমেদ সান, তোমার বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া উচিৎ। দেশটি নতুন। এর চাহিদা এবং সমস্যাও অনেক। তাই তোমার দেশে ফিরে যাওয়া উচিৎ। দেখ, আমেরিকায় তুমি যত ভালো গবেষণাই করো না কেন, যত বিখ্যাত জার্নালে সে সব প্রকাশ করো না কেন কেউ তোমাকে পুছবে না। আমেরিকায় বসে ‘ন্যাচার’ এর মতো বিখ্যাত জার্নালে দশটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করলেও এখানে কেউ তোমাকে চিনবে না, কেউ তোমাকে এর উপযুক্ত সম্মান দেবে না। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যদি স্বল্প পরিচিত কোনো জার্নালে বছরে একটি মাত্র গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ কর তবে সারা দেশ তোমাকে নিয়ে উল্লাস-নৃত্য করবে। কাজেই তুমি আমেরিকায় বেশিদিন থেকো না। আর এক বছর পরেই তুমি বাংলাদেশে ফিরে যাও। ওখানকার দারিদ্র্যের মাঝেই তুমি যে কাজ করবে বাংলাদেশ তার জন্যই তোমাকে মনে রাখবে’।
‘মনে আছে, তোমার পিএইচডি গবেষণার শেষ পর্যায়ে আমিই তোমাকে আমেরিকায় আসার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেম? আমার উদ্দেশ্য ছিল জাপানে তুমি এক ধরণের প্রশিক্ষণ পেয়েছো। আমেরিকায় ভিন্ন ধরণের গবেষণার পরিবেশেও তোমার কিছুটা প্রশিক্ষণ হওয়া জরুরী। এই দুই অভিজ্ঞতা নিয়ে তুমি যখন নিজ দেশে ফিরবে তখন বাংলাদেশের উপযোগী কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা তোমার পক্ষে খুব সহজ হবে। আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ, শুধু আমেরিকার কেন, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যবিজ্ঞান গবেষণাগার এনাইএইচ-এ আসার সুযোগ তুমি পেয়েছো। এই এক বছরেই তুমি তোমার মেধার স্বাক্ষর রেখেছো। আমি চাই আর এক বছর পরেই তুমি বাংলাদেশে ফিরে যাও। তোমার মতো লোকের এখনই প্রয়োজন বাংলাদেশের। দেশটি নতুন। কাজ করার বিষয়ের কোনো অভাব হবে না’।
‘আমি জানি তুমি বলবে অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ। সেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা কীভাবে করবে? দেখ, নিজেকে তোমরা এতো দরিদ্র ভেবো না। তোমাকে কি সারাদিন একবেলা না খেয়ে থাকতে হয়েছে? হয় নি। তবে শোনো আমার কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পররর্তী জাপানে জিনিসপত্রের ছিল আকাশচুম্বী দাম। আমাদের অনাহার অর্ধাহারেই দিন কাটাতে হয়েছে। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পুষ্টিকর খাদ্যের এতোই অভাব ছিল যে ক্লাশ করার জন্য সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠতে আমাদের কষ্ট হতো। তাই বিকালের ক্লাশগুলো যেন দালানের প্রথম তলায় নেয়া হয় সেজন্য সব ছাত্ররা মিলে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। বাংলাদেশের তো তেমন কোনো পরিস্থিতি হয় নি, হয়েছিল কি’?
‘আরো কি বলবো? এখন তো টেবিলে দশটা কলম বা বল পয়েন্ট পড়ে থাকে। তখন আমরা লিখতাম শিসার পেন্সিল দিয়ে। লিখতে লিখতে পেন্সিলটি ছোট হয়ে যেতো। এতোই ছোট হয়ে যেতো যে সেটি তিন আঙুল দিয়ে ধরে আর লেখা যেতো না। অথচ নতুন পেন্সিল কেনার পয়সা কারো নেই। তখন বাঁশের কঞ্চির মাথায় পেন্সিলের গোড়াটি বেঁধে, বাঁশের কঞ্চিতে ধরে লিখতাম। কিছুই অপচয় করতাম না। আমরা এমনই গরীব ছিলাম। আহমেদ সান, তোমাদের বাংলাদেশের তো তেমন অবস্থা কখনো হয় নি, তাই না? তাহলে কেন নিজেদের এতো গরীব ভাববে’?
‘কাজেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ এই অজুহাতে আমেরিকায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিও না। আমেরিকা তোমাকে কিছুই দেবে না। বাংলাদেশ তোমাকে সবই দেবে। তবে হ্যাঁ, পেটে খিদে নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করাটা বেশ কষ্টকর। সেটি লাঘবের জন্য আমি কিছু করতে পারি। ধরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুমি এবং জাপানের কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি জাপান সরকারের কাছে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্প পেশ করতে পারি। আমার বিশ্বাস তা মঞ্জুর হবে। সেই প্রকল্প থেকে তোমার কিছুটা পারিশ্রমিক আসবে। এর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া বেতন যোগ করলে ঢাকায় জীবনধারণ করাটা তোমার কিছুটা সহজ হবে’।
‘শুধু খাওয়া পরার সমস্যার সমাধান হলেই যে ভালো গবেষণা করতে পারবে তা তো নয়। চিত্ত বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকা চাই। ধরো গবেষণা প্রকল্পের অংশ হিসেবে এক বছর তুমি মাসখানেক সময় জাপানে আমার ল্যাবে কাটাবে। পরের বছর একই ভাবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার ল্যাবে কাটাবো। প্রতিবার ঢাকা যাওয়ার সময় আমি তোমার জন্য উপহার স্বরূপ রঙিন টেলিভিশন, ভিডিও ক্যামেরা বা তেমন কিছু নিয়ে আসতে পারি। মোট কথা ঢাকায় তোমার জীবন যেন সাচ্ছন্দে কাটে সেই ব্যবস্থা আমি করতে পারবো। কাজেই আমেরিকায় সময়ের বেশি অপচয় না করে তুমি বাংলাদেশেই ফিরে যাও’।
না, শেষ পর্যন্ত আমার বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া হয় নি। সোদা সেন্সেয় না বললেও নিজ থেকেই আমি ঢাকায় ফিরে যাবো সেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ফিরে যাবো পুরোপুরি মনস্থ করেও আমার শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে আর ফিরে যাওয়া হয় নি। কেন হয় নি সেসব বর্ণনা করলে প্রসঙ্গটি অন্য দিকে চলে যাবে। আজ আমি শুধু অধ্যাপক কেঞ্জি সোদা সম্পর্কেই বলতে চাই।
ডাক্তার এবং শিক্ষক অর্থে ব্যবহৃত হলেও জাপানি ভাষায় ‘সেন্সেয়’ শব্দের অর্থ অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। পণ্ডিতই বোধ হয় সবচেয়ে উপযোগী। আনুষ্ঠানিক সম্বোধনে উচ্চ বা সমমর্যাদার কারো নামের আগে ‘সান’ ব্যবহার করা হয়। ছাত্র বা কনিষ্ঠ কাউকে সম্বোধন করার সময় ‘সান’ এর বদলে ‘কুন’ ব্যবহার করা হয়। জাপানিরা এমনিতেই অনেক অমায়িক ও ভদ্র। কিন্তু জাপানি সভ্যতার মাপকাঠিতেও সোদা সেন্সেয় ছিলেন অমায়িকতম এবং ভদ্রতম। তাই তিনি কখনো আমাকে ‘আহমেদ কুন’ বলে সম্বোধন করেন নি, সব সময় ‘আহমেদ সান’ বলেই সম্বোধন করে এসেছেন।
১৯৭৯ সালের মার্চ-এপ্রিলের কোনো একসময় যখন অধ্যাপক কেঞ্জি সোদার সাথে আমার প্রথমবার দেখা হয় তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৬ বছর, আমার ২৮। তিনি তখন কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হলেও দেশে ও বিদেশে অনেক পূর্ণ-অধ্যাপক থেকেও বেশি নামজাদা ছিলেন। আমি আরেক অধ্যাপকের সুপারিশ নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর ল্যাবে। উদ্দেশ্য তাঁর অধীনে পিএইচডি করা ও বৃত্তি বা স্কলারশিপ পাওয়ার তদ্বির করা। তিনি হন্তদন্ত হয়ে সামনে এসে সম্মান দেখানো স্বরূপ বহুবার কোমর থেকে শরীরটি সামনে মাটির সমান্তরাল ঝুঁকিয়ে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। সেক্রেটারিকে চা দিতে বলে নিজের অপিস ঘরে সম্ভ্রমের সাথে সোফায় নিয়ে বসিয়েছিলেন। প্রথমেই তিন ফুট লম্বা, আড়াই ফুট চওড়া, ও তিন ইঞ্চি পুরু একটি বই সামনে দিয়ে অনুরোধ করেছিলেন আমার দেশটি পৃথিবীর কোথায় তা যেন তাঁকে দেখিয়ে দেই। তারপর সামনে রাখা একটি খাতায় আমার পুরো নামটি লিখতে বললেন। নামের প্রতিটি অংশের কোনটির কী অর্থ এবং কী ব্যবহার তা জিজ্ঞেস করে করে আমার উত্তর শুনে জাপানি ভাষায় তা খাতায় লিখে রাখলেন।
সেদিন ভিক্ষার হাত নিয়ে আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আমাকে রাজ-সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। হ্যাঁ, জাপান সরকারের মনবুশো স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে পরের জানুয়ারি থেকেই তিনি আমাকে তাঁর ল্যাবে স্থান দিয়েছিলেন। এরপর তিনটি বছর বিজ্ঞান গবেষণায় হাতে কলমে শিক্ষাদানের পাশাপাশি যে স্নেহ-ভালোবাসায় তিনি আমাকে সিক্ত করেছিলেন তা শুধু একজন পিতা থেকে পুত্রই পেতে পারে। আজ পেশা ও কর্মক্ষেত্রে আমার যা অর্জন তা তাঁর দানেই সম্ভব হয়েছে। আজও আমি সেই স্নেহের ঋণ কাঁধে বয়ে চলেছি।
প্রথম দিনের আলোচনায় সন্তুষ্ট হয়ে তিনি জাপান সরকারের মনবুশো বৃত্তির একটি বিশাল ফরম আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমার চেহারা দেখে বললেন এটি বেশ জটিল তা আমি জানি। কিন্তু ফরমটি পূরণ করতে আমি তোমাকে সাহায্য করবো। বললেন এতে পিএইচডি-র জন্য তুমি কী নিয়ে গবেষণা করতে চাও তার ফিরিস্তি দিতে হবে। তারপর বললেন জাপান সরকারের বৃত্তি পেতে হলে তোমার ইচ্ছাকৃত গবেষণার বিষয়ের সাথে আমার ল্যাবে কী ধরণের কাজ হয় তার সমতা থাকতে হবে। তুমি চাইলে এই পর্বটি তোমার হয়ে আমরা লিখে দিতে পারি যেন মনবুশো বৃত্তি পাওয়াটা তোমার জন্য সুবিধা হয়। বৃত্তি মঞ্জুর হয়ে গেলে তুমি ইচ্ছামতো তোমার গবেষণার বিষয় ঠিক করতে পার। তাঁর এই প্রস্তাব শুনে আমি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম।
ফরমটির নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে তাঁর ল্যাব সহকারী পেন্সিল দিয়ে হালকা করে আমার গবেষণার বিষয়ের বর্ণনা লিখে দিয়েছিলেন। সেই লেখার ওপর কালির কলম দিয়ে ঠিক একই কথা আমি লিখেছিলাম যেন মনে হয় এসব আমার নিজের লেখা। বিশাল কাগজের প্রায় ৫/৬ পাতার ফরমটি পূরণ হয়ে গেলে সেটি আমার হাতে দিলেন। বলেছিলেন ঢাকায় গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনের সুপারিশ ও প্রশংসাপত্র সহ যেন তাঁর কাছে ডাকযোগে ফেরত পাঠিয়ে দেই। আমি তাই করেছিলাম।
ফলে ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে আমি আবার কিয়োতো ফিরে আসি। ল্যাবে যোগ দেয়ার প্রথম দিনেই দুই সহযোগীকে সামনে রেখে তিনি কয়েকটি গবেষণা প্রকল্প আমার সামনে বর্ণনা করেন। একটি ছিল রেয়ন কারখানার একটি বর্জ্যকে ব্যাক্টেরিয়ার অনুঘটক এর সাহায্যে মানুষের খাদ্যের একটি আবশ্যিক এমানিনো এসিডে রূপান্তর করা। আকর্ষণীয় মনে হওয়ায় আমি সেটিই বেছে নিয়েছিলাম। উপস্থিত সবাই সাবধান করে বললেন ‘কিন্তু অনুঘটকটির কার্যকারীতা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। আগের দুই গবেষক এই কাজে সফলতা পায় নি’। কেন জানি মনে হলো কঠিন কাজকে সহজ করার মাঝেই সব আনন্দ। মুখে তা প্রকাশ করে বললাম আমি এটি নিয়েই গবেষণা করবো।
কিন্তু কাজ শুরু করে প্রায় এক বছর চলে গেলেও কিছুতেই আমি অণুঘটকটিকে বাগে আনতে পারছিলাম না। কারণ ব্যাক্টেরিয়ার দেহ থেকে বের করার পরপরই সে এতোই দ্রুত দূর্বল হওয়া শুরু করতো যে দুই বা তিন দিন পর কোনো কর্মক্ষমতাই আর থাকতো না। কর্মক্ষমতা না থাকলে আমার কাজও এগোতে পারে না। প্রতিটি বিফলতায় আমার জেদ বেড়ে চললো। কিছুদিন পরপর সোদা সেন্সেয় পরামর্শ দেন এই বেয়াড়া অণুঘটকটি ছেড়ে সহজ কোনো অণুঘটকের গবেষণা প্রকল্প যেন হাতে নেই। কিন্তু শুধু মনে হতো আমার বিফলতার পর অন্য কেউ সফল হলে একটি কথা চালু হয়ে যাবে যে ‘বহু চেষ্টা করেও বাংলাদেশের এক ছাত্র এর আগে কিছুই করতে পারে নি’। আমি তা হতে দিতে রাজি নই। বাংলাদেশের নামের সাথে আর কোনো কটুবাক্য জড়াতে দিতে আমি রাজি নই। অন্ততঃ আমা দ্বারা তা যেন না হয়। কাজেই আমার পরিশ্রম বেড়ে চলে।
এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন বাংলাদেশ ছিল রাজনৈতিকভাবে অস্থির ও পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ। জাপানি ও পাশ্চাত্যের পত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশ শব্দটি উল্লেখের আগে ‘সমস্যাসংকুল’, ‘দূর্ভিক্ষ-পীড়িত’, ‘বন্যা ও ঝড় কবলিত’, ‘দিশেহারা’, ‘পৃথিবীর দরিদ্রতম’, ইত্যাদি একাধিক বিশেষণ যোগ করে লেখা হতো। জাপানিরা পথেঘাটে বিদেশিদের দেখলে খুবই আগ্রহ দেখায় এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ শোনার সাথে সাথে আগুনে পানি দেয়ার মতো আমার প্রতি তাঁদের আগ্রহে ভাটা পড়ে। এ সব দেখে আমার কোনো কোনো বন্ধুকে নিজেকে ভারতীয় বলে পরিচয় দিতে দেখেছি। ল্যাবের ২৫-৩০ জন ছাত্র-গবেষক ভালো ইংরেজি বলতে পারে না বলে আমার সাথে মিশতেও দ্বিধাবোধ করে। ফলে নিজেদের মাঝে জাপানিতে কথা বলার সময় বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে আমি প্রচণ্ড হীনমন্যতা অনুভব করি।
প্রায়ই বিদেশ ভ্রমণ এবং বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকলেও অধ্যাপক সোদা তা লক্ষ করে থাকবেন। তাই সুযোগ পেলেই আমাকে সঙ্গে নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে যান। প্রতি বছর ল্যাবের সবাই মিলে বিভিন্ন শহরে অন্ততঃ তিনটি বৈজ্ঞানিক সমেলনে যাওয়া হতো, থাকাও হতো জাপানি স্টাইলের গণ-হোটেলে, গোসল হতো গণ-স্নানাগারে। সে সব ক্ষেত্রে সোদা সেন্সেয় প্রথমেই তিনটি ঘোষণা করে দিতেনঃ আহমেদ সানের ঘুমানোর জায়গাটি সর্বোত্তম হতে হবে, স্নানঘরে সে প্রথমে এবং একা ঢুকবে, এবং শুকর-জাত কিছু কোনো খাবারে থাকলে বাবুর্চি যেন তা জানাতে ভুল না করে। অবসর সময়ে আমাকে এক সময় জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা যে খুব খারাপ ছিল সে সব গল্প শোনান। সে সব কাটিয়ে জাপান এখন বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়ার পথে। আমি এবং আমার মতো তরুণরাও যে বাংলাদেশের সমস্যাগুলো যে দূর করতে পারবো তাতে তিনি নিশ্চিত ধারণা পোষণ করে আমার মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ধরণের বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয় জানতে চাইতেন। বলতাম ওখানে গবেষণার সরঞ্জাম এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক জার্নালের খুব অভাব। সেই আলোচনার সময় বলতেন দেখ সব গবেষণাতেই যে বিশ্বমানের সরঞ্জাম থাকতে হবে তা নয়। যেটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে একটি অনুসন্ধিৎসু মন এবং সমস্যা সমাধানের তীব্র আকাংখা। শুধু এই দুটি উপাদান থাকলেই তুমি বিশ্বমানের গবেষক হয়ে উঠতে পারবে।
এই যে সেদিন তোমার সাথে অধ্যাপক ওসামু হায়াইশি-র পরিচয় করিয়ে দিলাম। জাপান থেকে জৈব-স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে কেউ যদি নোবেল প্রাইজ পান তবে প্রথমেই আসবে তাঁর নাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা-গবেষণা করতে গিয়ে দেখলেন কাজ করার মতো যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক সরঞ্জাম এবং কেনার মতো পয়সা, কিছুই নেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত দালানের আনাচে কানাচে খুঁজে পেলেন ট্রিপটোফ্যান-এর অব্যবহৃত একটি বোতল। ঠিক করলেন তিনি সেটি নিয়েই কাজ করবেন। কয়েক বছরের মধ্যেই ট্রিপটোফ্যানের একটি পরিবর্তিত রূপ প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন গবেষণায় বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন। তোমাদেরও সেরকম কিছুই করতে হবে।
এরপর তিনি নিজের ক্লিষ্টতার ও কৃচ্ছতার কথাও শোনালেন। দেশের দুর্দিন তখনো শেষ হয় নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ নিয়েছেন। গবেষণাগারে ব্যবহারের উপযুক্ত ছাকনি বা ফিল্টার পেপার কেনার সামর্থ নেই। পুরনো খবরের কাগজ ভালো করে ধুয়ে নিয়ে তা দিয়ে চলতো ছাঁকনির কাজ। গবেষণা করতেন ‘গ্লুটামেট ডিকার্বক্সিলেয’ নামে অণুঘটক বা এনযাইম নিয়ে। কুমড়ার বীজ থেকে অণুঘটকটি আহরণ করতে প্রয়োজন ছিল আধুনিক যান্ত্রিক শীল-পাটা বা হোমোজিনাইযার এর। কিন্তু তা কেনার মতো পয়সা নেই। তখন অসংখ্য ছিদ্র যুক্ত একটি টিনের পাতের খসখসে পিঠে দুই আঙ্গুলের মাঝে ধরে একটি একটি কুমড়ার বীচি পিষতে হতো। ‘তা করতে গিয়ে গ্লুটামেট ডিকার্বক্সিলেয আমার দেহের রক্তে কতো যে রঞ্জিত হয়েছিল তার হিসাব রাখিনি।’
একদিন এক বিশাল বাঁধানো বই আমার হাতে দিয়ে বললেন এটি দ্যাখ। বই বললেও এটি আসলে বিভিন্ন লোকের হাতে ইংরেজিতে লেখা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ। দিন তারিখ ও প্রবন্ধকারের নাম ঠিকানা সহ বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধের ঠিক অনুরূপ। সেন্সেয় বললেন গবেষণার প্রয়োজনে বৈজ্ঞানিক জার্ণাল কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা নেই। সারা দেশে একমাত্র টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকা থেকে প্রকাশিত উচ্চমানের ‘জার্ণাল অব বায়োলজিক্যাল কেমিস্ট্রি’ কিনে থাকতো। সেই জার্ণাল পড়া ও ব্যবহার করার জন্য টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন থেকে সাত দিনের সময় চেয়ে নিতে হতো। সেই কয়দিন টোকিওতে থাকা খাওয়ার খরচ হিসেবে কাছাকাছি কয়েকটি শহর ওসাকা, কিয়োতো, নারা, এবং কোবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসাহী গবেষকরা নিজের পকেট থেকে চাঁদা তুলে একজন স্বেচ্ছাসেবককে দিতেন। আর দিতেন চাঁদা প্রদানকারী গবেষকদের প্রয়োজনীয় বিষয়ের একটি ফর্দ বা লিস্টি। সেই স্বেচ্ছাসেবক টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে রাতদিন একনাগাড়ে খেটে ফর্দ অনুযায়ী গবেষণা পত্রগুলি হাতে লিখে আলাদা আলাদা ভাবে কপি করতেন। আজ আমরা যেভাবে কম্পিউটারের পিডিএফ অথবা যেরক্স মেশিনে ফটোকপি করে বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র পেয়ে থাকি, কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-গবেষকরা হাতে লেখা কপি সেভাবেই পেতেন। আমার হাতে ধরা বাঁধানো বইটি ছিল সোদা সেন্সের ফরমায়েশের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের কপির সংকলন।
এই কৃচ্ছতার ও পরিশ্রমের প্রতিদান তিনি পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে গ্লুটামেট এবং আরো অনেক এমাইনো এসিড রাসিমেয, ডিকার্বক্সিলেয, এবং ট্রান্সামিনেয অনণুঘটকের গবেষণায় তিনি বিশ্বখ্যাতি পেয়েছিলেন। অনেক নতুন নতুন অনণুঘটক আবিষ্কার ছাড়াও নতুন রাসায়নিক বিক্রিয়াও আবিষ্কার করেছেন। জাপানি ও ইংরেজি ভাষায় কয়েকশত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের প্রণেতা ছাড়াও বেশ কয়েকটি পুস্তকেরও জনক তিনি। জাপান, কোরিয়া, চিন, ভারত, বাংলাদেশ, ফ্রান্স, বুলগেরিয়া, পোলান্ড, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের অসংখ্য বিজ্ঞানী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে আজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে।
আমি তাঁর প্রথম বিদেশি ছাত্র নই। আমার পূর্বে তাঁর ল্যাবে রাশিয়া, যুগোস্লাভিয়া, ও কোরিয়া’র গবেষকরা কাজ করে গেছেন। কাজেই আমার প্রতি তাঁর স্নেহ বেশি ছিল তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
যাই হোক, জাপানে গবেষণার কাজে একাগ্রতা ও পরিশ্রম আমাকে বিফল করে নি। সোদা-ল্যাব থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে ন্যুনতম পাঁচ বছরের গবেষণা-সাফল্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু কাজ শুরু করার আড়াই বছরে মাথায় সোদা সেন্সেয় ডেকে বললেন তোমার সাফল্য ও অগ্রগতিতে আমি খুব সন্তুষ্ট। এবার পরীক্ষা কমিটির কাছে তুমি তোমার থিসিস পেশ করতে পার। বললাম সেন্সেয় একবার দেশে ফিরে গেলে আবার কবে বিদেশে আসতে পারবো ঠিক নেই। পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলাম বলে এতোদিন বিয়ে করার কথা চিন্তা করি নি। কাজেই থিসিস পেশ করার আগে দেশে গিয়ে বিয়ে করে আসতে চাই। তাহলে অল্প কয়েকটি মাস হলেও স্ত্রীকে নিয়ে বিদেশে থাকা হবে।
তখনকার জাপানি সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষকরাই হতেন ছাত্রদের ভবিষ্যৎ চাকুরি এবং বিবাহ, সব কিছুরই অভিভাবক। আমার কথা শুনে উৎসাহী হয়ে সেন্সেয় বললেন ঠিক আছে কনের ছবি দেখাও, বায়ো ডাটা দেখাও, পারিবারিক ঐতিহ্যের ফিরিস্তি দেখাও। তা দেখে আমি কনের মা-বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠাবো। হেসে বললাম, কাকে বিয়ে করবো নিজেই তো তা জানি না।
বললাম, আমার মা-বোনেরা কিছু পাত্রী দেখে রাখবেন, আমি ঢাকায় গিয়ে তাঁদের একজনকে বিয়ে করবো। সাথে সাথেই বললেন তাহলে তাঁদের দেখে রাখা সবগুলো পাত্রীর ফিরিস্তিই তাঁকে যেন দেই। সেসব দেখে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত দেবেন। তাঁকে আমাদের সামাজিক রীতিনীতি বুঝিয়ে বললাম। তবে আশ্বাস দিলাম যে ঢাকায় যাওয়ার পর আমার পরিবা্রের পছন্দের পাত্রীর বায়োডাটা এবং তাঁর পরিবারের ইতিবৃত্ত জানিয়ে তাঁর কাছে অবশ্যই পাঠাবো। তিনি সম্মতি দিলেই আমি বিয়ে করবো। আর বললাম আপনি বরং একটি স্পন্সরশিপ চিঠি দিন যেন বিয়ে করা স্ত্রীকে আমি সাথে করে জাপানে নিয়ে আসতে পারি। সেই চিঠিতে আমার স্ত্রীর নামের স্থানটি শূন্য থাকবে। ঢাকায় গিয়ে বিয়ে করার পর নামটি আমি বসিয়ে নেব। তিনি তাই করেছিলেন। আমার বিয়ের সংবাদ জানার সাথে সাথে ল্যাবের সবার পক্ষ হয়ে তিনি অভিনন্দন জানিয়ে একটি টেলিগ্রামও করেছিলেন।
জাপানে পড়াশোনা শেষে ১৯৮৩ সালে আমি আমেরিকা চলে আসি। এর পর অধ্যাপক সোদা যতবারই আমেরিকার পূর্বাঞ্চলে এসেছিলেন, প্রতিবারই আমার সাথে দেখা করে গেছেন। তাঁর আমন্ত্রণে দুইবার আমিও জাপানে দুটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনে অতিথি-বক্তা হয়ে গিয়েছিলাম। শেষবার দেখা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে, যে বছর তিনি কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যান।
****
অধ্যাপক কেঞ্জি সোদার জন্ম ১৯৩৩ সালের ৭ই জানুয়ারি মধ্য জাপানের গিফু প্রিফেকচার (বৃটিশ-ভারতের পরগনা বা আমেরিকার কাউন্টি বলা যেতে পারে)-এ সাড়ে তিনশত বছরের একা প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত ‘সাকে’ মদ্য-প্রস্তুতকারী পরিবারে। স্কুলে পড়ালেখার সময় শখ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন পর্বতারোহণ। পিতামাতা চেয়েছিলেন শিক্ষা সমাপ্ত করে বংশের সাড়ে তিন শত বছরের পুরনো মদ্য ব্যাবসাটির হাল ধরবেন। কিন্তু আর পিতৃপেশায় ফিরে না গিয়ে তিনি বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা। তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় মদ্যপানেও তিনি ছিলেন অনেকটা রক্ষণশীল, কদাচিৎ মদ্যপান করতেন। যখন করতেন, মাতাল হওয়ার কাছাকাছিও পৌঁছাতেন না কখনো। কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি এবং বোস্টনের টাফট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আলটন মাইস্টার এর অধীনে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা শেষ করে কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হলেন ১৯৬৩ সালে। ১৯৮১ সালে পূর্ণ অধ্যাপকে পদোন্নতি হয়ে ১৯৯৬ সালে কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যান। এরপর জাপানের কান্সাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ও অধ্যাপক হিসাবে শিক্ষকতা ও গবেষণা চালিয়ে যান ২০০৩ সাল পর্যন্ত। কর্মজীবনে তিনি কয়েক বছর ‘জাপানিয বায়োকেমিক্যাল সোসাইটি’ এবং ‘ভিটামিন সোসাইটি অব জাপান’ এর সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও তিনি রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স এর একজন সদস্য।
অধ্যাপক সোদা স্কুল জীবন থেকেই পর্বতারোহণে আগ্রহী ছিলেন। যৌবনের পুরোটাই জাপানের বিভিন্ন পর্বতারোহণ করেই কাটিয়েছেন। শিক্ষা ও গবেষণা জগতে প্রবেশ করায় এর কিছুটা ভাটা পড়েছিল। কিন্তু পর্বতারোণের শিক্ষাকে তিনি গবেষণার কাজে লাগিয়েছিলেন। পর্বতারোহণে প্রথমেই প্রয়োজন হয় আরোহণের পর্বত চূড়াটি নির্ধারণ করা – বিশেষ করে যে চূড়ায় আগে কেউ আরোহণ করে নি। এর পরের প্রয়োজন নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও একাগ্রতার সাথে সেই চূড়ায় আরোহণ করা। এই তিনটির কোথাও গাফিলতি থাকলে কেউ তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। পর্বতারোহণের সর্বশেষ কাজ চূড়ায় পৌঁছে তা বিশ্ববাসীকে জানানো। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রেও প্রথম প্রয়োজন গবেষণার বিষয়বস্তুর লক্ষ স্থির করা – বিশেষ করে যেটি নিয়ে আগে কেউ কোনো গবেষণা করে নি। এর পরের প্রয়োজন উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা নির্ধারণ, এবং একাগ্রতার সাথে তা সম্পন্ন করা। আর সবশেষে প্রয়োজন গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করা। অধ্যাপক সোদার জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অণুঘটক নিয়ে গবেষণার ব্যাপারে তাঁর মনোভাব ছিল নতুন নতুন পর্বত চূড়ায় প্রথমবারের মতো আরোহণ করার মতোই।
শিক্ষকতা ও গবেষণায় প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর প্রথমে তিনি কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় পর্বারোহণ ক্লাবের সভাপতি হন। এবং পরে ‘একাডেমিক আল্পাইন ক্লাব অব কিয়োতো’র পরিচালক হিসেবে নবীন পর্বতারোহীদের শিক্ষা ও নেতৃত্ব দিতেন। আরো পরে তিনি জাপান আল্পাইন ক্লাবেরও সভাপতি হয়েছিলেন।
এছাড়া প্রতিবছর তাঁর ল্যাবের যে বনভোজন হতো, তার স্থানটি নির্ধারণ করা হতো কাছাকাছি কোনো পাহাড়ের চূড়ায়। সাড়ে তিন বছর অবস্থান কালে আমি নিজেও এই অভিযানে যোগ দিয়েছি। ল্যাবের কুড়ি পঁচিশ জন ছাত্র এবং একটি মাত্র ছাত্রী প্রত্যেকের ঘাড়ে খাদ্য ও রান্নার সরঞ্জাম কাঁধে নিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে চূড়ায় যখন পৌঁছাতাম তখন আমার প্রাণ প্রায় যায় যায় অবস্থা হতো। শুধু আমিই নই, কোনো কোনো জাপানি ছাত্রেরও একই দশা হতো। কিন্তু কারো পিছিয়ে যাবার জো নেই, কারণ সামনে নেতৃত্ব রয়েছেন সোদা সেন্সেয়। পর্বতশৃঙ্গে রান্না ও খাওয়াদাওয়া শেষে মদ্যপান যারা পছন্দ করে তাঁরা মাতাল অবস্থায় টলতে টলতে নিচে নেমে আসতো।
আরো দুটি শখ তাঁর ছিল। একটি ছিল চাইনিজ ক্যালিগ্রাফি। সপ্তাহের এক বিকেলে এক শিক্ষক আসতেন ল্যাবে মোটা তুলিতে কালো কালি লাগিয়ে সাদা কাগজে চিনা ভাষার শৈল্পিক প্রকাশ ঘটাতে। তাঁর আরেকটি শখ ছিল চিনা কবিতা চর্চা। এখন ছিয়াশি বছরের কুঁজো হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ বয়সে তিনি নতুন আরেকটি শখ রপ্ত করেছেন। পানির রং-তুলি দিয়ে ছবি আঁকা। এবার আমার জন্য তেমন অপূর্ব দুটি ফুলের ছবি উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন। দেখে মুগ্ধ হয়ে এক সম্পাদক ঢাকার 'শিক্ষালোক' নামে সাহিত্য সাময়িকীর প্রচ্ছদরূপে একটি প্রকাশ করেছিল।
জাপানি ভাষায় ‘সোদা’ নামটি খুব অপরিচিত। লেখা হয় চিনা চিত্র-লিপি দ্বারা – যার অর্থ দাঁড়ায় ‘ডান (ও) বাম ক্ষেত (জমি)’। যে কেউ এই নামটি পড়েই বেশ মজা পায় ও হাসে। নিজের নাম নিয়ে কৌতুক করে তিনি বলেন এক অর্থে আমি খুবই বিখ্যাত। ইংরেজিতে উচ্চারিত সোডা পৃথিবীর অনেক লোকই প্রতিদিন পান করে থাকে। আর জাপানি অর্থ ‘ডান বাম ক্ষেত’। নামের সাথে সামঞ্জস্য রাখতেই হয়তো আমি বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয় ঠিক করেছি রাসেমেয ও ট্রান্সেমিনেয অণুঘটক। এই অণুঘটকগুলো ডান-হাতা ও বাঁ-হাতা এমাইনো এসিড নিয়েই কারবার করে।
তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন ২০০৬ সালে। এক সকালে পায়ে হাঁটা প্রাতঃভ্রমণ শেষে ঘরে ফিরে দেখেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তাঁর স্ত্রী মেঝেতে মৃতাবস্থায় পড়ে আছেন। হাসপাতালে পরীক্ষা করে জানা গেল হৃদপিণ্ড থেকে বের হওয়া এওর্টা রক্তনালীটি ভেতর থেকেই ছিঁড়ে যাওয়ায় প্রায় সাথে সাথেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। এটি অত্যন্ত বিরল একটি ঘটনা। তাঁর মৃত্যুসংবাদে আমি যারপর নাই ব্যথিত হয়েছিলাম। অত্যন্ত অমায়িক, ভদ্র, ও স্নেহশীল এক মহিলা ছিলেন। আমি এবং আমার স্ত্রীকে অনেকবার তাঁর বাসায় আপ্যায়ন করেছিলেন। প্রথম যেদিন তাঁকে দেখেছিলাম সেদিনকার একটি কথা এখনো মনে আছে। ল্যাবের কুড়ি পঁচিশজন ছাত্রের সবার তাঁর বাসায় বার্ষিক দাওয়াত ছিল। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে তিনি একাই সবার জন্য রান্নাঘর থেকে একের পর এক খাবার এনে দিচ্ছেন। আর এক কোণে বসে সব অতিথির দিকে নজর রাখছেন। হাতে সিগ্রেট নিয়ে আমি গল্পে মত্ত ছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম পরিষ্কার একটি ছাইদানি নিজ থেকেই আমার সিগারেটের নিচে এগিয়ে আসছে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে দেখলাম পেছন থেকে গুরু-গিন্নী তা করছেন। পরক্ষণে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আঙ্গুলে ধরা সিগ্রেটটির ছাই অনেকটা লম্বা হয়ে গিয়েছিল।
গুরুগৃহে সেদিনের পানাহারের এক পর্যায়ে আমি বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছিলাম। এ বাড়িতে নতুন এসেছি, কাকে এবং কীভাবে বাথরুমের কথা জিজ্ঞেস করবো বুঝে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ লক্ষ করলাম অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথে পেছনে দাঁড়িয়ে গুরুপত্নী বলছেন আমার সাথে এদিকে আসুন। আমি বললাম, না, না, আমি তো এখানে বেশ আছি। তিনি বললেন আসুন, আপনাকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিচ্ছি। কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যাবার আগে আগে সোদা সেন্সেয় সস্ত্রীক আমেরিকায় বেড়াতে এসেছিলেন। তখন তাঁদের সাথে আমি বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম। সেটি ছিল তাঁর সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ।
এই বয়সেও সোদা সেন্সেয় একাই নিজের বাড়িতে বসবাস করেন। নিজের দুবেলার খাবার নিজেই রান্না করেন। প্রয়োজনে কাছে বাস করা কন্যা এসে সঙ্গ দেয়। অবসর সময়ে ছবি আঁকেন, আর মঞ্চ নাটক ও অপেরা দেখতে যান। বাকি সময়টা কাটে পাড়ায় হনহন করে হেঁটে হেঁটে। আর বছরে কয়েকবার টোকিয়োয় ছেলের বাসায় অথবা ছেলে বা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যান।
এবার আমেরিকায় এসেছিলেন তাঁর কন্যা, জামাতা ও নাতনীকে সাথে নিয়ে। রাতে ঘুমানো ছাড়া বলতে গেলে বাকি সময়টা আমার সাথেই ছিলেন। তাঁর একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। মেয়েটি বড়, নাম ইউকিকো, আমার ছাত্রাবস্থায় সে স্কুলছাত্রী ছিল। সোদা সেন্সেয় জানিয়েছিলেন কলেজে সে চিনা কবিতার ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছিল। এবার যখন পিতার সহযাত্রী হয়ে আমেরিকায় আসে তখন তাঁর বয়স পঞ্চান্ন বছর। এখন সে একটি কন্যাসন্তানের মা ও গৃহিণী। মেয়েটিরও বয়স হয়েছে, এখনো বিয়ে করে নি, চাকুরি করছে। সোদা সেন্সেয় জানালেন তাঁর ছেলে নাওকি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক। নাওকির একটি ছেলে ও একটি মেয়ে।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেলেও দ্বিতীয় দিন পুরো ছয়টি ঘন্টা ধরে হাঁটলেন মোট ৮.৯৭ মাইল। কন্সটিটিউশন এভেনিউ থেকে হোয়াইট হাউজ হয়ে ন্যাশনাল একাডেমি অব সাইন্স, রিফ্লেক্টিং পুল থেকে ১৭৮টি সিড়ি ভেংগে লিংকন মেমোরিয়ালে উঠে ও নেমে, কোরিয়ান ওয়ার মেমোরিয়াল, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার মেমোরিয়াল, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়াম, এবং এয়ার & স্পেস মিউজিয়াম দেখে হেঁটে ক্যাপিটল হিলের কাছে রাখা গাড়িতে ফিরে এলেন।
সন্ধ্যায় সবাই মিলে আমাদের বাসায় এলেন রাতের খাবার খেতে। কাকতালীয়ভাবে একই দিনে স্ত্রী ও পুত্র সহ বেড়াতে এসেছিল আমার বড়ছেলে, এবং ছোটছেলে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম সোদা সেন্সেয় তাদের সাথে পরম উৎসাহের সাথে গল্প করে গেলেন ঘন্টার পর ঘণ্টা। আমার ছেলেরা এবং বৌমা তাঁর স্মৃতিশক্তি ও প্রাণচাঞ্চল্যে যারপরনাই বিস্ময় প্রকাশ করলো।
তবে যে ব্যক্তিটি এবার আমাকে বেশি মুগ্ধ করেছে সে হচ্ছে তাঁর জামাতা, নাওকি স্তুতসুমি। যে চারদিন ওয়াশিংটন ডিসিতে তাঁরা আমার সাথে কাটালেন প্রতিদিন যে ধৈর্য ও মমতার সাথে তিনি শ্বশুরের আরাম আয়েশের দিকে নজর দিলেন তাতে আমি অভিভূত হয়ে গেছি। নিজে একটি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক কোম্পানির উচ্চপদস্থ ও দায়িত্বশীল কর্মচারী। প্রায় সারা বছর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানো তাঁর কাজ। এ হেন ব্যক্তি নিজের ও স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে একেবারেই গুরুত্ব না দিয়ে তাঁর শ্বশুর কী দেখতে, কোথায় যেতে, ও কী খেতে পছন্দ করবেন তাতেই বেশি মনযোগী ছিলেন। আর আমি যতবার আমার গুরুর সাথে আলাপে মগ্ন ছিলাম বা রাজপথে অথবা পানির ধারে হেঁটে বেড়িয়েছি, লক্ষ করেছি সেই মুহূর্তগুলোকে গভীর মনোযোগের সাথে তিনি ক্যামেরাবন্দী করে চলেছেন। এখান থেকে তাঁরা চলে যাওয়ার পর আবিষ্কার করলাম তিনি একজন যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী। একটি অর্কেস্ট্রা দলের ভায়োলিন বাদক। জাপানের বাইরেও প্রদর্শণ করেছে দেখে মনে হয় দলটি জনপ্রিয়ও হয়তো। মুরুব্বি এবং বয়োজ্যেষ্ট ব্যক্তিদের সম্মান করা এবং যত্ন নেয়া বাঙালি ও ভারতীয়রাই বেশি করে থাকে বলে এতোদিন মনে করে এসেছিলাম। কিন্তু নাওকি স্তুৎসুমি আমার সে ধারণাকে ভেঙে চুড়মার করে দিল। তাঁর মতো এতো ভালো মনের একটি মানুষের সাথে পরিচিত হয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
১লা জুন, ২০১৯