অমিত মাথা নিচু করে বলেছিল-‘কারণ তাহলে তোমার ভালোবাসার অভিনয়টাকেও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।
Published : 06 Feb 2025, 09:58 PM
নির্দিষ্ট সময়েই শেয়ালদা থেকে ছেড়ে দিল রাজধানী এক্সপ্রেস। টু-টিয়ার ক্যুপ-এ অন্য যাত্রীদের দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই লোকটির। আপন মনে একটা বই খুলে বসেছে লোয়ার টিয়ারে। সার্জের প্যান্টের ভেতরে বুশসার্ট গুঁজে রাখা প্রশস্ত ললাটের অমিত সেনকে যেন এই একবিংশ শতকে মানায় না। ক্লিন সেভড, ব্যাকব্রাশ, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। একবাক্যে ষাটের দশকের লোক বলে দেওয়া যায়।
হাওড়া ছাড়তেই ট্রেনের গতিবেগ ১৩০ কিলো। উল্টোদিকের পরিবারটি সম্ভবত এ ট্রেনে নতুন, তাই গতি বাড়তে খানিকটা উসখুস শুরু করল। ভয় কাটাতেই হয়ত ওপাশেরজন জিজ্ঞেস করল-‘দাদা স্পিড কি আরও বাড়বে?’ অমিত শুনেও না-শোনার ভান করে উত্তর দিল না। লোকটি আবারও প্রশ্নটি রিপিট করল-‘দাদা….’ ‘না না, আর বাড়বে না, এই গতিতেই চলবে’ বলে আবার বইয়ে মুখ গুঁজল অমিত। লোকটি হয়ত মনে মনে ‘অসামাজিক’ ভেবে চুপ হয়ে গেল।
অমিতের চোখ বইয়ের পাতায়, কিন্তু মনের মধ্যে বয়ে চলেছে সাইক্লোন… কী হবে? জ্যোতি কি স্টেশনে আসবে? মনে থাকবে তো ওর? মনের ভেতরকার ক্যালেন্ডার একবার মনে করিয়ে দিল-কত বছর পার হয়েছে জানো অমিত? চার বছর! এত লম্বা সময় পরে একটি নির্দিষ্ট দিনে কেউ একজন আসবে এটা কে মনে রাখতে পারে?
পরক্ষণেই নিজেকে আশ্বস্ত করল-জোতি আসবে। কিসের জোরে এমন নির্ভরতা? অমিত আর জ্যোতি দুজনের দেখা হয়েছিল এই রাজধানী এক্সপ্রেসেই, পাঁচ বছর আগে। সেবারও এমন একটি ক্যুপে ওরা দুজনই যাত্রী ছিল। দিল্লি থেকে ছেড়ে আসা ওই ট্রেনের অমিত আসবে কলকাতা। জ্যোতি নেমে যাবে কানপুর। ওই অতটুকু সময়ে ওদের পরিচয়, ঘনিষ্টতা, নির্ভরতা এতটাই দৃঢ় হয়েছিল যে অমিত কানপুরেই জ্যোতির সঙ্গে নেমে যেতে চেয়েছিল। পুরুষের এই এক সুবিধা; সে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতে পারে। জ্যোতি নামতে দেয়নি।
সেদিনের সেই আলাপে অমিত যেমন বাঙালিয়ানা হিন্দিতে বলার চেষ্টা করেছিল, জ্যোতি তেমনি ভাঙা ভাঙা বাংলা বলছিল। অমিতকে যেমন পয়তাল্লিশ থেকে ষাটের ঘরে বলে দেয়া যায়, জ্যোতিকেও তেমনি পয়ত্রিশ থেকে পয়তাল্লিশ মনে করা যায়। দুজনের স্বামী বা স্ত্রী কিংবা সন্তান আছে কীনা কেউ জিজ্ঞেস করেনি। আশ্চর্যজনকভাবে যেন দুজনেই ধরে নিয়েছিল; দুজনই কুমার-কুমারী!
বইটা বন্ধ করে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখে অমিত…. ফ্যকাসে কালো রাত। কুয়াশা ভেদ করে মিটমিটে চাঁদের আলো। সেদিন ছিল মাঘী পূর্নিমা। এক পর্যায়ে জ্যোতি বাংলা শেখার-বলার আগ্রহ কীভাবে জন্মেছিল তা বলেছিল। রবীন্দ্রনাথ! একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেই জ্যোতি বাংলার প্রেমে পড়েছিল… ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই’
পুরো গানটি অমিত গেয়ে শুনিয়েছিল। তারপর দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে। এর মধ্যে সাধারণত যেভাবে পরিচয় পর্ব থেকে ধীরে ধীরে কথামালা প্রেমময় হয়ে ওঠে তেমন কিছুই হয়নি ওদের। অথচ ওই সামান্য সময়ে দুজন দুজনের শৈশব থেকে বর্তমানের পুরোটা ইতিহাস বলে ফেলেছিল। এমনকি কার কোন বিষয়ে এলার্জি তাও।
দুজনের হাতেই মোবাইল সেট রয়েছে। তারপরও কেউ কারও নম্বর দেয়া-নেয়া করেনি! কেন ফোন করবে না? এর উত্তরে অমিত বলেছিল-মোবাইল খুব ভালনারেবল ডিভাইস। প্রতি মুহূর্তে বিশ্বাস অর্জন করে, আবার প্রতি মুহূতেই ভাঙেও। জ্যোতি হাসতে হাসতে বলেছিল-তবে কি আমরা সিক্টিজ-সেভেনটিজের মত চিঠি লিখব? সাথে সাথে অমিত সায় দিয়ে বলেছিল-হ্যাঁ, আমরা চিঠি লিখব। দেখা করতে আসব। তুমি যাবে, আমি আসব…। শেষে জ্যোতি খিল খিল করে হেসে বলেছিল-আউর ইসি তারাহ হামনে এক দুসরোকো প্যাহচান লুঙ্গি।
‘দাদা একটা নাড়ু নিন, বাড়ির, মা বানিয়েছে’…. হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পায় অমিত। উল্টোদিকের ভদ্রমহিলা হাত বাড়িয়ে ধরেছে। অনিচ্ছা স্বত্বেও নিল অমিত। ও জানে এখনই মহিলাটি গপ্প শুরু করবে। করলও। অমিতের নিরাসক্ত কণ্ঠ শুনে বেশীক্ষণ স্ট্যামিনা রাখতে পারল না। ট্রেন আসানসোল পার হয়ে এসেছে।
এবার চোখ বন্ধ করল অমিত। হালকা একটা দুলুনি দিয়ে স্মৃতি ফিরে গেলে সেই ট্রেনের কামরায়…. চিঠির প্রসঙ্গে জ্যোতি হঠাৎই বলে বসেছিল-‘ভালোবাসবেন?’ চকিতে ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও কিসে যেন আটকে গেল অমিতের কণ্ঠ। শান্তস্বরে বলল-‘না’। জ্যোতি ভীষণ অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে বুঝতে চাইল….। অমিতের শক্ত চোয়ালের নির্লিপ্ত মুখে কোনও উত্তর খুঁজে পেল না। মনে মনে ভাবল একজন পুরুষ কী করে বলতে পারে ভালোবাসব না! কী করে? একাধিক প্রেমে দাগা খেয়েছে? তাতে কী? প্রেম কি জীবেন একবারই আসে? ভেবে ভেবে কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে জিজ্ঞেস করল-‘কেন?’
অমিত মাথা নিচু করে বলেছিল-‘কারণ তাহলে তোমার ভালোবাসার অভিনয়টাকেও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।‘ এবার রাগে-দুঃখে জ্যোতির চোখে জল এসে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল-‘বিশ্বাস এমনই এক রহস্য যাকে ভেঙে যেতে দেখার পরও মানুষ আবারও বিশ্বাস করে, কারণ বিশ্বাস ছাড়া মানুষ বাঁচে না।‘
এবার চমকে ওঠার পালা অমিতের। ধীরে পায়ে জ্যোতির সিটে গিয়ে পাশে বসে মাথার উপর হাত রাখল। চমকে উঠল জ্যোতি! ভয় পাচ্ছে। এবার কি অমিত সাধারণ পুরুষ হয়ে উঠবে? নিশ্বাস ভারী হতে শুরু করল জ্যোতির। মনে হচ্ছে যেন কত যুগ ধরে অমিত ওর মাথায় হাত রেখে বসে আছে! অমিত বিড়বিড় করে বলল-
জিসম কি বাত নেহি থি
উনকে দিল তাক জানা থা…
লাম্বি দূরি ত্যায়র কারনে মে
ওয়াক্ত তো লাগতা হ্যায়
প্যায়ার কা পাহলে খত্ লিখনে মে
ওয়াক্ত তো লাগতা হ্যায়….
বিস্ময়ের ঘোর-লাগা এক মাদকতাময় অদ্ভুত দৃষ্টিতে অমিতকে দেখতে থাকে জ্যোতি… অনেকদিন আগে শোনা জগজিৎ সিংয়ের গজলটা মনে পড়ে গেল। সত্যিই তো; জিসম কি বাত নেহি থি
উনকে দিল তাক জানা থা…লাম্বি ডোরি, ত্যায় কারনে মে ওয়াক্ত তো লাগতা হ্যায়… । অমিতের হাতটা মাথা থেকে নামিয়ে নিজের গালের সঙ্গে চেপে রাখল…। হঠাৎ জ্যোতি ঘড়ি দেখে শশব্যস্ত হয়ে উঠল-কানপুর আসতে বেশি দেরি নেই।
এর পরে ওদের মধ্যে তেমন কথা হল না। জ্যোতি চায়ের ফ্লাক্স জলের বোতল ব্যাগে ভরে নামার জন্য তৈরি। দুটো চিরকুটে দুজন দুজনার ঠিকানা বিনিময় করল। এর কয়েক মিনিট পরেই স্পিকারের ঘোষণা-নেক্সট স্টেশন- কানপুর জাংশন। জ্যোতি ব্যাগ নিয়ে রেডি। অমিতও উঠে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ জ্যোতি অনেকটা অনুমতি চাওয়ার মত বলল-‘গালে লাগ যাউ?’ অমিত সম্মতিসূচক মাথা নাড়ার আগেই দুজন মানুষ প্রবল আলিঙ্গনে এক হয়ে রইল মিনিট খানেক। জ্যোতি অনেকটা জোর করেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। একসঙ্গে কামরার দরজা অবধি আসল। স্টিয়ার থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইল জ্যোতি। ট্রেন ছেড়ে দিতেই মুহূর্তে গতিবেগ বেড়ে গেল। তারই মধ্যে চিৎকার করে জ্যোতি বলল—টিঠি কা ইন্তেজার লাম্বি কারনা মাৎ’ তারপর পরিষ্কার বাংলায় ‘শুভরাত্রি’…অমিতের ‘জরুর’ বা ‘শুভরাত্রি’ জ্যোতি শুনল কীনা বোঝা গেল না।
কলকাতা ফিরে পরদিনই চিঠি লিখেছিল অমিত। গুনে গুনে সাতদিন বাদে উত্তর আসল। এরপর নিয়মিত চিঠি যাওয়া-আসা। এক একবার অমিতের মনে হতো-কী অদ্ভুত ব্যাপার! পৃথিবীর সকল মানুষ মোবাইলে কথা বলে ভিডিও কল করে মুখোমুখি দেখাদেখি করে…. আর ওরা পড়ে আছে সেই ষাটের দশকে! এক একবার মনে হতো ফোন নম্বর বা হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর চেয়ে নেয়। পরক্ষণেই নিজেকে শাসন করত- মোবাইল ইজ আ ভালনারেবল ডিভাইস। প্রতি মুহূর্তে বিশ্বাস অর্জন করে, আবার প্রতি মুহূতে ভাঙেও। অমিত গত কয়েক মাসে চোস্ত হিন্দি রপ্ত করেছিল। ওদিকে জ্যোতি একটার পর একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত মুখস্ত করছিল। একবার ‘হার মানা হার পরাব তোমার গলে’ গানটির এই ‘হার’ মানে যে নেকলেস নয় সেটা ধরিয়ে দেয়ার পর জ্যোতি বাংলা শেখায় আরও মনোযোগী হয়।
ছয়-সাত মাস পরে চিঠির সংখ্যা কমে আসল। জ্যোতির চিঠির উত্তর দিতে অমিতের দেরি হতে লাগল। অমিতের চিঠি পাওয়ার পর জ্যোতি দশ-পনের দিনের বদলে মাস খানেক পর উত্তর লিখত। যখন চিঠির সংখ্যা কমছে, ডিউরেশন বাড়ছে তখন অমিত ভাবতে শুরু করল-ও কি অন্য কারও সঙ্গে সময় দিচ্ছে? সহজাত পুরুষ ভাবনা। তেমনি জ্যোতিও ভাবতে শুরু করল-পুরুষ মানুষ শুধুই দিলকি বাত পার গুজারতি? জিসম কিছুই না? তা কী করে হয়? এতদিনে ওরা জেনেছে অমিতের স্ত্রী-সন্তান সব আছে, তবে তারা তাদের মত। আলাদা। অমিত একা থাকে। জ্যোতির বিয়ে হয়েছিল। এক রাতও টেকেনি। লোকটা সিনেমার গল্পের মত, বাবার বন্ধুর ছেলে। অনেক টাকা। রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়িতে ফেরে। তাই বলে বাসররাতেও? হ্যাঁ, বাসর রাতেই জ্যোতি দেখেছিল লোকটা তাকে জাস্ট রেপ করতে চাইছে। নিউক্লিয় সায়েন্স পাশ জ্যোতি ওই একটি রাতই সহ্য করতে পেরেছিল।
আট-ন’ মাসের মাথায় দুজনের চিঠি আদান-প্রদান প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছিল। নিজের বয়সী কোনো বন্ধু নেই অমিতের। আছে দশ বছরের বড় এবং কুড়ি বছরের ছোট তরুণ। তেমনই এক তরুণ বন্ধুর কাছে অমিত তাদের পুরো ব্যাপারটা শেয়ার করেছিল। শেষে চিঠি আসা বন্ধ হওয়ার কারণও জানতে চেয়েছিল লজ্জার মাথা খেয়ে। তরুণটি মোটেও সময় ব্যয় করেনি। ঝটপট বলেছিল-‘দাদা তুমি নিশ্চিত থাকো থার্ড পার্সনের এন্ট্রি ঘটেছে। আর তুমিও! পড়ে আছ সেই সেকেলে মাল হয়ে! কি না মেসেজ করবে, ফেসবুকে কানেক্ট থাকবে, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করবে… তা না, সেই মান্ধাতা আমলের চিঠি! ওতে কিসসু হয় না দাদা।‘
অমিত এভাবে ভাবতে চায়নি। প্রতিবাদ করে বলেছিল-‘সবই কি তোদের ওই সূত্রমত হয় নাকি?’ ছেলেটা এবার হো হো করে হেসে বলেছিল-‘শোনো দাদা। একটা বাণী দিলুম, কোনো পোড় খাওয়া মালের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখো, বলবে-পার্ফেক্ট।‘
‘যখন কেউ রিলেশন থেকে মুভঅন করতে চায় তখন কিছু কমন ঘটনা ঘটেঃ রিলেশন আছে কিন্তু আগের মত সময় দিচ্ছে না। কথা হচ্ছে কিন্তু নিষ্প্রাণ দায়সারা। আগে যেসব ছোট ছোট বিষয়ে হাসাহাসি হতো এখন সেসব কথাতেই ঝগড়া শুরু হচ্ছে। নানা অযুহাতে সময় দিচ্ছে না। নেহাত দয়া-সৌজন্য দেখিয়ে কথা হচ্ছে কিন্তু কথায় সেই প্রাণ নেই। ‘আগের মত কেন নেই’ প্রশ্নের উত্তরে আসে বিভিন্ন বাহানা। এমন সিচ্যুয়েশন ক্রিয়েট করে যাতে তুমি নিজেই সরে আসো। এর মানে তোমার উপস্থিতি সে আর চাইছে না। এখানে থার্ড পারসনের এন্ট্রি ঘটেছে, কিন্তু সেটা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। নিজে থেকে ব্রেকআপ করবে না যেন তার ওপর দোষ না চাপে। তখন এমন আচরণ করবে যাতে তুমি নিজেই সরে আসতে বাধ্য হবে।‘
‘এসব বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বললুম। ও আমার ঢের দেখা আছে।‘
সম্বিত ফিরে ঘড়ি দেখল অমিত। এমন সময় স্পিকারে ঘোষণা আসল- নেক্সট স্টেশন- দীন দয়াল উপাধ্যায় নগর জংশন। এই নামটা শুনে মেজাজ খারাপ হয় অমিতের। সেই শৈশবে উপন্যাসে কত বার পড়েছে মুঘলসরাই জংশন। নামটা মনের মধ্যে ভীষণরকম নস্টালজিক শোনাত। মনের চোখ দিয়ে দেখত কয়লার গুড়ো মাখা লাইনসম্যানের হাতে লাল-সবুজ লণ্ঠন…. ঘটাং ঘটাং করে ট্রেন এসে থামছে। ফেরিওয়ালারা হাকডাক করে বলছে-‘ইয়ে বাবু হিয়া জারা দের লাগ পাড়ি, উতারকে খানা লিজিয়ে… ইয়ে মুঘলসরাই আপকি খিদমতমে…’
চার বছর আগে সর্বশেষ চিঠিতে অমিত লিখেছিল; ‘আবারও এক মাঘী পূর্নিমার রাতে আমি আসব। ‘ এই চিঠির উত্তর আসেনি। অমিত গত চার বছর ধরে কী করেছে, কেন আসেনি, কেনই বা চার বছর বাদে আজ ট্রেনে চেপে বসেছে সে ইতিহাস কেউ জানবে না, কারণ সিনেমার মত জীবনকে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো যায় না। গত চার বছরে হয়ত চারশ’ বার অমিত আসতে চেয়েছে। আবার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। সেসময়কার কাঁচাপাকা চুল এখন প্রায় পুরোটা পাকা। মুখের বলিরেখা আরও স্পষ্ট। ওজন কমেছে। চশমার পাওয়ার বেড়েছে। হাতের ওপরকার শিরাগুলো ফোলা ফোলা। অনেকটা কেঁচোর মত। মাথার মাঝখানে ফাঁকা হয়েছে। এসব কি জ্যোতি অনুমান করতে পারে? নিজেই উত্তর দেয় পারে, নিশ্চয়ই পারে। তারও তো বয়স বেড়েছে। চার বছরে বহুবার ভেবেছে জ্যোতি হয়ত বিয়ে করে ঘরসংসারী হয়েছে। আচ্ছা ওর ছেলে হয়েছে না মেয়ে? কী নাম তার? হেসে উঠতে গিয়ে হাসতে পারে না অমিত। সেই কথাটা মনে পড়লে রাগে দুঃখে নিজেকে ঝেড়ে গালাগাল দেয়। কী ভয়ানক সত্য কথাটা, অথচ মনে হয় যেন ভ্যালুলেস…’ কারণ তাহলে তোমার ভালোবাসার অভিনয়টাকেও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। ‘ তবে কি সত্যিই জ্যোতি শর্মা অভিনয় করেছে?
অমিত জানবে কী করে যে চিঠি বন্ধ হওয়ার পরের মাঘী পূর্নিমায় কানপুরে রাজধানী এক্সপ্রেসের অ্যারাইভাল টাইমে স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছিল জ্যোতি। তার বিশ্বাস ছিল অমিত আসবে। ট্রেন এসে চলে গেছে। জ্যোতিও ক্লান্ত পা-দুটো টেনে টেনে বাড়ি ফিরেছে। তার পরের দুবছরও বছরের ওই নির্দিষ্ট রাতে জ্যোতি স্টেশনে এসেছে। শেষবার গত বছর তীব্র শীতে সেই পূর্নিমা রাতে জ্যোতি আবারও এসছিল। আর সেবারই মনস্থির করেছিল পথ চাওয়ার শেষ হলো। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হতো সেই নো মোবাইল শর্ত মেনে নেওয়ায়। একবার ভেবেছিল অমিতকে চিঠি দিয়ে জানায়। পরমুহূর্তে নারীর চিরন্তন রহস্যঘেরা ভেতর-মন মানা করেছিল। শিশুর মত ঠোঁট ফুলিয়ে বলতে ইচ্ছে করেছিল-‘তুমি কী করে জানবে অমিত, জ্যোতি কত রাত কত দিন তোমার পথ চেয়ে বসে থেকেছে? কী করে জানবে তুমি এক একটা পূর্নিমা রাতে ভগ্নমনে ঘরে ফিরে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করেছে?’ তবুও জ্যোতি জানতে দিতে চায় না কেন সে চিঠি বন্ধ করেছিল। প্রথম প্রথম কথাটা বলবার জন্য বুকের ভেতর তোলপাড় হতো। মনে হতে পেট ফুলে মরে যাবে। পরে নিজেকে শাসন করত-প্যায়ার কা আখরি খত্ লিখনে মে ওয়াক্ত তো লাগতা হ্যায়….
কৃপায়ে ধ্যায়ান দিজিয়ে…. বারা হাজার ইকুছ হাওড়া-দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস হাওড়া-দিল্লি চালনেছে রাস্তে তুরান্ত বাদ কানপুর স্টেশনকা চার নাম্বার প্ল্যাফর্ম পে রুখনেওয়ালে হ্যায়। হম আপকি সফল-সুফল এবং মঙ্গলময় ইয়াত্রা কামনা কারে….
কোনোকিছু গোছগাছ করার ছিল না অমিতের। ছোট্ট ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মনে মনে বিড় বিড় করতে থাকে-দেখা হতেই কী বলবে ও…. ‘কেমন আছ?’ নাহ, বড্ড কমন। তাহলে? শুধুই নাম ধরে ডাক দেবে-জ্যোতি! তাও মনে ধরে না। বুকের ভেতরটা এতক্ষণ ভালোই ছিল। এখন কেমন যেন গলার কাছটাতে দলা পাকিয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে জল খেলে ভালো লাগত। ট্রেন ক্রমশ ধীর হচ্ছে…. এক সময় বিজাতীয় কর্কষ শব্দে ট্রেন থেমে গেল। লোকজন ঠেলাঠেলি হুড়োহুড়ি করে নামছে-উঠছে।
শান্ত ধীর পায়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ল অমিত। স্টেশনে শত শত মানুষ, কিন্তু জ্যোতি কোথায়? একটু হেঁটে মাঝ বরাবর এসে দাঁড়াল। কতক্ষণ সময় কেটেছে জানে না। হঠাৎ দেখল ট্রেন ছেড়ে চলে গেল। ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে আসছে প্ল্যাটফর্ম। খুব ধীরে ধীরে একশ’ আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে নিল চোখ দুটো… কোথাও জ্যোতি নেই! হঠাৎই নিজের নির্বুদ্ধিতায় হতবাক হলো…. টানা চার বছর ধরে যে মানুষটার সঙ্গে সামান্যতম যোগাযোগ নেই। বেঁচে আছে কীনা তাও জানা নেই। সেই মানুষটা কী করে জানবে কলকাতা থেকে অমিত সেন আজকের পূর্নিমা রাতে আসছে! কে মনে রাখে পাঁচ বছর আগের কোনো এক রাতের কথা?
চিৎকার করে নিজেকে কষে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করল। এখন এই ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে ও একাই দাঁড়িয়ে আছে আহম্মকের মত। আজ আকাশে মেঘ করেছে। স্টেশনের ঝলমলে আলোয় চাঁদের আলো ম্লান দেখাচ্ছ। দূরে একেবারে স্টেশনের শেষে কালো একটা কাঠামো! একজন মানুষ কি দাঁড়িয়ে আছে? পরক্ষণেই মনে হলো চোখের বিভ্রম। বুকের ভেতরে উথাল-পাথাল করা হার্টবিট শুনতে পাচ্ছে……ধক ধক…ধক ধক…ধক ধক…
১৮ জানুয়ারি ২৫