রোমিলা থাপারের মত ইতিহাসবিদরা সবসময়েই বলেন, ভারতবর্ষ কখনো একরৈখিক ধর্মীয় দেশ ছিল না।
Published : 04 Feb 2025, 07:25 PM
এই গল্পটা নেহাতই অনেকদিনের হয়ে গেল। বয়সে প্রায় আটশো বছরের ওপর পুরোনো। দিল্লির অলিগলি তখনও রাজপথ হয়ে ওঠেনি, মানুষের মনেও তখনো পরধর্ম জিঘাংসা তেমন হুম হুম করে এমন দাঙ্গাবাজ হয়ে ওঠেনি। তেমন সময়ের দিল্লি নগরে এসেছেন এক সাধক, হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া ((১২৩৮–১৩২৫)। সুফি তার আত্মা। আর যে সময়ের কথা, সেইসময় তার সঙ্গে ছিলেন তাঁর অনন্য অনুসারী, তাঁর ছায়া, তাঁরই নিজ আত্মার এক প্রতিচ্ছবি—কবি, সুরকার, গীতিকার সুফি সাধক আমির খুসরো (১২৫৩–১৩২৫)।
একদিন, দরগায় এক মৃত্যুর খবর এলো। তাকিউদ্দিন নূহ, নিজামুদ্দিনের ভ্রাতুষ্পুত্র, আর নেই। বাউলের মত যিনি গেয়ে উঠতেন সহজিয়া, পায়ে পায়ে নাচের ঘূর্ণীতে যিনি উথাল পাথল দিগন্তে মায়া-মায়া সফেদ ছড়াতেন, সেই আনন্দময় তিনি তখন শোকে পাথর। দরগাহের দরজা বন্ধ। ভক্তরা আসছে যাচ্ছে, কিন্তু প্রিয় সাধকের মুখে একটিও কথা নেই। নির্বাক চেয়ে থাকেন নিজামুদ্দিন। আর দুই চোখ বেয়ে পড়ে পানি।
গুরু’র এমন শোকার্ত দিনে মনমরা হয়ে ঘোরেন খুসরোও। দিন চলে যায়। এমন এক বিমর্ষ সকালে, কোকিলের কলকণ্ঠ অগ্রাহ্য করেই দিল্লীর পথে-পথে ঘুরে ফিরছেন খুসরো। হঠাৎ চোখে পড়ল- রাস্তাময় হলুদের সমারোহ। দিল্লির অলিতে গলিতে সর্ষে ফুলের গন্ধ। আর পথে পথে মেয়েরা হলুদ রঙের অনন্য বসন পরে ঢোল আর মঞ্জীরা বাজাতে বাজাতে বসন্ত পঞ্চমীর গান গাইতে গাইতে চলেছে । বসন্ত রাগে, ললিতে তার আবাহন করছেন। মোহাবিষ্ট খুসরো দাঁড়িয়ে পড়লেন- কী যেন এক মোহ, এক আকর্ষণ। তিনি ঘোরের মাঝে বলে উঠলেন, “কোথায় যাচ্ছ?”
মেয়েদের দল, আসুন অনুমান করি- হয়তবা খলখল করে হেসে উঠে বলেছিল- আজ দেবী সরস্বতীর পূজা। দেবীর আরাধনায় তারা কার কাছে ফুল ‘চড়াতে’ যাচ্ছে।
খুসরো তখন তার টেমপেস্টের প্রসপেরোকে ফিরিয়ে আনতে আকুল। তিনি মুগ্ধ হলেন। এই প্রাণোচ্ছ্বলতা, এই হলুদের আলো, এই সুর—এটাই তো জীবন। মৃত্যু তো তার উলেটোপীঠে। তার মাথায় খেলে গেল এক আনন্দী মহোৎসব। সে এই কুদরতী রঙ্গ। এই বসন্ত আনন্দের অবগাহনে। মুহূর্তে এক হলুদ বসন জোগাড় করতে চলে গেলেন। নিজে সেই হলুদ শাড়ি পরে নিলেন, হাতে নিলেন সরষে রঙা ফুল, আর বিভোর হয়ে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে সোজা দরগাহর ভিতরে ঢুকে পড়লেন। তার দুচোখে অশ্রু।
নাচতে নাচতে কখন যে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সামনে এসে পড়লেন তা নিজেও জানেননা খুসরো। দাঁড়িয়ে কাঁদছেন- হাসছেন আর হলুদ পুষ্পগুলি তাঁর গুরুর পায়ে উপুড় করে করে দিচ্ছেন। শোকার্ত সাধকের চোখের কোনায় জল। এক চন্দন-বাতাস বয়ে যাচ্ছে দরগার দিকে দিকে। সরষে ফুলের হলুদ, খুসরোর পাগলপন, তার ভালোবাসার শক্তি— দীর্ঘদিন পর নিজামুদ্দ্দীন হেসে ওঠেন। শিশুর প্রায়। অবিচল, মোহাবিষ্ট খুসরো গুরুর দেহে-শরীরে হলুদ পুষ্পের বৃষ্টি করতে করতে নেচে নেচে অনর্গল অস্ফুটে বলে চলেছেন- আজ রং হ্যায়। আজ রং হ্যায়।
সেই থেকে আজো, প্রতি বছর বসন্ত পঞ্চমীর দিনে, দিল্লির নিজামুদ্দিন দরগায় সুর ওঠে, “আজ রং হ্যায়!”
সুফি পঞ্চমীর দিল্লীতে এই কিংবদন্তির রং রামনবমীর তরবারি উল্লাসের কাছে মিলিয়ে যাক তা ভারতের অভিজ্ঞান কখনও চায়নি। তার অঙ্গুরীয় ছিল এই বাসন্তী।
রোমিলা থাপারের মত ইতিহাসবিদরা সবসময়েই বলেন, ভারতবর্ষ কখনো একরৈখিক ধর্মীয় দেশ ছিল না। এখানে ছিল মিশ্রণ, সংলাপ, সাহচর্য ইত্যাদি। আর কিংবদন্তি ইতিহাসেরও এক উপাদান। তাকে বিশ্লেষণ করা চলে। সেইখানে চোখ রেখে- এই গল্প শুধু কিংবদন্তি নয়, খানিক ইতিহাসও। আর ইতিহাস পথ করে চলে।
তাই আজও এই দিনে দিল্লীর দরগায় কাওয়ালি ওঠে, খুসরোর গান হয়—হলুদ রঙের বসন পরে তাল ওঠানো হয় সুরে, বসন্তের আনন্দগানে। আর হয় হলুদ পুষ্পের বাসন্তী বারিশ।
সাধারণত, সুফি দরগাহগুলোতে এমন রঙিন উৎসব কমই দেখা যায়। তাই আকাদেমির চর্চায় বিদ্বানদের চোখে সুফি বসন্ত: ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়। এই পঞ্চমীর শিকড় বহু শতাব্দী পুরনো, যখন ভারতের মাটি সুফি সাধক ও ভক্তির কবিদের পদচারণায় স্বাভাবিক ছিল। দিল্লি সালতানাতের উত্থানের সাথে সাথে, সুফিবাদ ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া—এই সুফি তরীকাগুলো মানুষের মনে কেবলই প্রেমের শীর্ষ উস্কে দেওয়ার কাজ করছিল।
খুসরো বললেন-আজ রং হ্যায়। কিন্তু খুসরো শুধু মনে হয় হলুদ এই এক রঙের কথাও বলতে চাইছিলেননা। তিনি বরং এক রং-এর এক দিল্লীর কথা, ভারতবর্ষের কথা বলতে চাইছিলেন-, যেখানে হলুদ রং শুধু ধর্মের থেকে আরো বেশী উৎসবের। সংস্কৃতির। যেখানে বসন্ত শুধু দেবীর নয়, দরগারও। যেখানে গান শুধু উপাসনার নয়, প্রেমেরও। তবে তা বাঙালির বইমেলার মাঝে পঞ্চমী- ভ্যাল্নটাইন প্রেমের চেয়ে কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বমুখী। মানব, মানবী, না মানুষে, আর অন্য সব মানুষে মাখামাখি।
বসন্ত পঞ্চমী, বা “সুফি বসন্ত,” এই এখনের রামরাজত্বের রাজধানীতে সেই সুবর্নরেখার পরিত্যক্ত এয়ারোড্রোমটির মত। যেখানে বালিকা সীতার পথ আটকে মহাকাল ভয় দেখায়। তখন এমনদিনে এমন কথন, এমন বসন্তের উপাখ্যান, হয়ে উঠতে পারে আমাদের মহাকাব্য। এই সুফি বসন্ত শুধু বসন্ত পঞ্চমীর উৎসব নয়। হয়ে উঠুকনা বসন্তের মহোৎসব । শুধু রং। পুষ্প। সুর, কাব্য আর সংগীতের মহোৎসব।
ঐতিহাসিক আন্নেমারি শিমেল বলেন,
“ভারতীয় সুফিবাদ ধর্মের সীমারেখাকে অস্পষ্ট করে দিয়ে প্রেম ও সঙ্গীতকে প্রধান করতে চাইছিল।”
তখন বুঝতে অসুবিধা হয়না এ আসলে এক প্রতিরোধের কাহিনি। ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে নিস্তার পাওয়ার সহজিয়া মধ্যপন্থা।
যেমন নিজামুদ্দিন আউলিয়া শোক ভুলে হাসলেন, যেমন দরগার আঙিনায় কাওয়ালি উঠল, তেমনই আমির খুসরোর কাব্যে আমাদের সেই অলীক প্রেমরোগ অমোঘ হল-
“যে ডুবল, সে-ই পার হলো।”